ফ্যান্টাসি নামক ডিপ্রেশন


বলা হয় এই যুগটা আধুনিকতার যুগ,এই যুগটা সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার যুগ।কিন্তু এই যে 'সভ্যতা' এই যে 'চরম উৎকর্ষতা' নামক শব্দগুলোকে দিয়ে আমাদের কান ঝালা-পালা করে দেওয়া হয় সেই শব্দগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ কি?

আমাদের (মুসলিমদের) কাছে সভ্যতার যে আলাদা একটা সংজ্ঞা আছে,উৎকর্ষের আলাদা মানে আছে সেটার সাথে আজকের সভ্যতার আর চরম উৎকর্ষের কি সম্পর্ক?।আমরা সবাই একটা ফ্যান্টাসির জগতে বাস করছি।যেখানে আদৌ কোন সুখ তো নাই,বরং হতাশা,দুঃখ,বিষাদ আর শুধু প্রতিযোগিতা।


"কে কার চেয়ে বড় হতে পারে"। এই 8@9 ধরুন,"আপনার এক বন্ধুর দামী বাইক আছে,গাড়ী,অনেক টাকা-পয়সা আছে,আপনি সোশাল মিডিয়ায় তার চলাফেরা,বাইক,সুন্দর জামা-কাপড় দেখে দুঃখ পাচ্ছেন,হতাশায় ভূগছেন।আপনি মনে মনে এমন ভাবেন বা আফসোস করেন,"আমার যদি বাইক থাকত,আমার বাবা টাকাওয়ালা হলে আমিও এমন সোশাল মিডিয়ায় ছবি দিতাম"


আল্লাহ বলেছেন,"তোমার যা আছে তুমি তার দিকে তাকাও আমি যা তোমাকে দেই নি সে বিষয়ে আমি কোন প্রশ্ন করা হবে না"


আর আমরা কি করছি?অন্যের জীবন নিয়ে আফসোস করি।আপনি সুস্থ আছেন এর চেয়ে বড় নেয়ামত আর কি হতে পারে?হাসপাতালে জরুরী বিভাগে গিয়ে পাঁচ মিনিট দাঁড়ালে বুঝা যায় জীবনে কতটা সুখে আছেন।আপনি তবুও হতাশায় ভূগী,অন্যের জীবনের সুখ নিয়ে কথা বলি।


একটা বিষয় একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন,আমরা ফেইসবুক কাদের Follow করি?যাদের টাকা-পয়সা আছে,সুন্দর চলাফেরা করে,বা অনেক উচ্চবিত্ত জীবন-যাপন করে। অর্থাৎ আপনার চেয়ে যাদের ধন সম্পদ বেশি আছে তাদেরকে আপমি Follow করেন।এসব দেখে আমরা নিজেদের জীবন নিয়ে আফসোস করি।আমরা শুধু তাদের সুখময় মূহূর্ত গুলাই দেখি।দিনশেষে ভাল ভাবে খবর নিয়ে দেখে তারা সুখী না।তার জীবনে হয়তো এমন কোন কষ্ট আছে যেটা সে কাউকে বলতে পারে না।আর আমরা?তার সুখময় ছবি কিংবা ভিডিও দেখে আফসোস করি।একটু লক্ষ্য করুন,আমরা ফেইসবুক বা যেকোন সোশাল মিডিয়ায় কোন ছবিগুলো আপলোড করি?সব ছবিই কি আপলোড করি?ধরুন আপনি দশটি ছবি তুলেছেন দশটির ভিতর যে ছবিগুলো ভাল হয়েছে,আপনার হাসি বা আপনাকে সুন্দর দেখাচ্ছে সেই ছবিগুলোই আপলোড দেই।

আপনি মানুষকে দেখাচ্ছেন আপনার সৈন্দর্য্যকে?বরং আল্লাহ তা'য়ালা এটা নিষেধ করেছেন।আল কুরআনে বলা আছে,"তোমরা তোমাদের সৌন্দর্য্য নিয়ে অহংকার কর না কেননা অহংকার ধংস করে দেই"।


ঠিক তেমনি আপনি যার ছবি,বাইক,ইত্যাদি দেখে আফসোস কষ্ট পাচ্ছেন সেও ছবি আপলোড দেয়ার সময় ভাল ছবিগুলোই আপলোড করে।আর তার দুঃখের সময়গুলো তার টাইমলাইনে শেয়ার দেয় না সুখ গুলোই মানুষকে দেখায়।কারন সে বুঝাতে চায় সে তার জীবনকে উপভোগ করছে।বাস্তবে জীবনে সে আপনার মতই জীবন-যাপন করে।আপনি আপনার সমাজে খেয়াল করবেন যারা সাদা-মাটা জীবন,আল্লাহর পথে চলে,নামাজ পড়ে,আল্লাহ দেয়া বিধান মেনে চলে বা মেনে চলার চেষ্টা করে।তারাই দিনশেষে পাট শাক,আলু ভর্তা,সাদা ভাত খেয়ে চোখ বুঝে রাতে একটা সুন্দর ঘুম দেয়।


অন্যদিকে টাকাওয়ালা রাতে ঘুম নাই,সুগার খেলে ঢায়বেটিস বাড়ে,ভাত খেলে ওজন বেড়ে যাবে,রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়েও ঘুম আসে না। কালকে অর্ধলক্ষ,লাক্ষ কিংবা কোটি টাকার চুক্তি করতে হবে,ছেলেকে টাকা দিতে হবে,স্ত্রী শপিং এ যাবে টাকা দিতে হবে।শুধু

অশান্তি,হতাশা,আফসোস।


অন্যদিকে একজন ঈমানদার রিকসা ওয়ালা যহুরের নামজ পড়ে রিকসাটাকে রাস্তার পাশে রেখে চলে যায় তার নড়বরে ছোট টিনের ঘরটায়।স্ত্রী দুপুরে ভাত না খেয়ে বসে থাকে কখন তাঁর স্বামী আসবে বুকের ওড়না দিয়ে স্বামীর কপালে ঘাম মুছে দেবে,প্লেটে ভাত দিয়ে হাতে একটা পাখা নিয়ে বাতাস দিতে থাকে।আর স্বামীর পাশে বসে তাকিয়ে থাকে তার কি প্রয়োজন,কি লাগবে সেদিকে খেয়াল রাখে।


আমি এমন একটা দৃশ্য দেখেছি যেটা আমার বলতেও ইস্ততবোধ হয়,বসুন্ধরায় একবার এক মহিলা তার স্বামীকে লাথি দিচ্ছে, (আস্তাগফিরুল্লাহ)।কি যেন কিনে দিতে বলছে লোকটা বার বার বলতেছে এখন টাকা নেই সাথে পরে কিনে দেব,ছোট বাচ্চাটি কোলে কতক্ষন বাবার মুখে দিকে তাকাচ্ছে আবার মায়ের দিকে।


আবার,ধরুন আপনার গায়ের রং একটু কালো বা শ্যামলাটে আপনি আপনার বন্ধুর কিংবা ফর্সা কাউকে দেখে মনে মনে আফসোস করেন,"আমি যদি আরেকটু ফর্সা হতাম বা ওর মত আমার গায়ের রঙ টা হত"


এই বিষয়টা ছেলেদের ক্ষেত্রে একটু কম হয় কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি।বাহ্যিক সৌন্দর্য্য নিয়ে প্রায় প্রতিটা মেয়েই কম বা বেশি হিনমন্যতায় ভূগে।শুধু আমাদের দেশে না পৃথিবীর সব জায়গায় বাহ্যিক সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দিচ্ছে,বডি শেপিং এর ব্যাপারটা এখন একটা ট্রেন্ডে পরিনত হয়েছে।


কিছু কিছু মানুষ নিজেদের ওজন কমাতে শুরু করে বিভিন্ন ব্যায়াম করে।আস্তে আস্তে দেখা যায় খাওয়া কমিয়ে ফেলে।প্রায় সময়ই ফলস্বরূপ দেখা যায় বিভিন্ম রোগে আক্রান্ত হয় এবং ডিপ্রেশনে চলে যায়। 


আমরা সৌন্দর্য্যের মাপকাঠি হিসেবে এটাই ধরে নিছি একটি মেয়ের ক্ষেত্রে,সাদা চামড়া মানেই সুন্দর,চিকন গড়ন লাগবে,উচ্চতা ৫' ফিট ৩'' ইঞ্চি আইডল বা পারফেক্ট উচ্চতা।এইগুলোকে সৌন্দর্যের স্কেল/সিলেবাস করে নিয়েছি।আচ্ছা, কে দিয়েছে এই সিলেবাস করে দিয়েছে?আপনার রব?আমি আপনাকে প্রশ্ন করতে চাই,"আপনার রব কি এমন কোনো সিলেবাস করে দিয়েছে?"


আপনার রব যদি তা নির্ধারিত না করে দিয়ে না থাকেন, তাহলে কেন আপনি এ সব নিয়ে হিনমন্নতা,হতাশা,দূঃখে ভূগছেন?আসলে আমরা ইসলামকে বিশ্বাস করি,কিন্তু এর কথাগুলি মানি না।কেন আপনি একজন মানুষ খাটো,মোটা,কালো এসব নিয়ে কষ্ট,হিনমন্নতা,হতাশায় ভূগবেন?শুধুমাত্র কিছুসংখ্যক মানুষের "বাহ" পাবার জন্য?একজন মেয়ে হিসেবে আপনার সৈন্দর্য্যকে শুধুমাত্র আপনার স্বামী এবং যাদেরকে আপনার জন্য হালাল করা হয়েছে তাদের তাহলে, আপনার জীবনে এত হতাশা কেন?


আপনার কি মনে নেই?না আপনি ভূলে যাচ্ছেন আমানার রব,কোনো কিছু অসুন্দর করে সৃষ্টি করেন নি।রবের প্রতিটা সৃষ্টি চমৎকার থেকে চমৎকারতম।আল্লাহ তা'য়ালা বলেন,

"অবশ্যই আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে  সুন্দরতম অবয়বে"(সূরা- ত্বীন,আয়াতঃ ৪). 

 

আপনাকে কেউ যদি বডি শেমিং করে চুপ থাকেন,মহান আল্লাহর উপর ভরষা রাখুন,তিনি আপনাকে নিঁখুত ভাবে তৈরী করেছে,আপনি যেমন তিনি সেটাই পছন্দ করেন।আল্লাহ আপনাকে যেভাবে চান,আল্লাহ আপনাকে সুন্দর বলেছে,অন্যেরা কি বলল বা না বলল তা কি আসে যায়?আপনি আজ থেকে এটাকে মনে প্রানে বিশ্বাস করে নিন,"আমার আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট"।আর নিজেকে নিজে বলুন,"আমি সুন্দর,হ্যাঁ আমি সুন্দর কেননা আমার রব আমাকে সুন্দরভাবেই সৃষ্টি করেছেন।


আর যারা এইসব নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছেন তারা কি রবের বিরুদ্ধে বলছেন না?যেখানে রব বলেছেন।তিনি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে সৃষ্টি করেছেন সেখানে আপনি তা নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছেন?কাউকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার আগে প্রত্যেকটা মানুষ তার নিজ নিজ অবস্থা থেকে এক অন্য রকম সৌন্দর্য্য বহন করে থাকে, যা স্বয়ং তার রব তাকে দিয়েছেন,সেখানে আমি আপনি রবের সৃষ্টির খুঁত খুঁজে বেড়াচ্ছি।


পরিশেষে বলতে চাই,আমরা শুধু নিজেদের এবং অন্যদেরকে কিছু উন্মাদ প্রতিযোগিতায় নিমগ্ন হয়ে আছি  যা শেষ পর্যন্ত আমাদের আখিরাতের জন্য কোন লাভ হবে না।আমরা কেউই ভাবি না, "মরলে কি জবাব দিবো আল্লাহর কাছে?"এই প্রশ্ন সম্পর্কে কেউ কিছু বলে না।পাশ করে বিদেশে যাবো, চাকুরী করবো,ব্যবসা করবো,অনেক টাকা হবে, প্রতিষ্ঠিত হব, সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করব,গাড়ি কিনব এটাই আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য।এইসব প্রতিযোগীতা করতে গিয়ে আমরা কী যে হারাচ্ছি!এটা কবরে না গেলে আমরা বুঝব না।যেকোন সময় মৃত্যুর ডাক আসতে পারে।বিশ্বাসি কিংবা অবিশ্বাসী একদিন তার জীবনে অক্সিজেন নামক গ্যাস আর নাকে ডুকবে না আবার বেরওহবে না।সময়টা কেউই জানি না।আমি বা আপনি যদি জানতে পারি আজ বা কাল বা এমন কোন তারিখ যেদিন মৃত্যুবরন করব সেদিনটা রবের জন্য কিভাবে কাটাবেন?ওইদিন যেভাবে দিন-রাত কাটাবেন ঠিক সেভাবেই কাটান।কারন আমরা কেউই জানি না কখন বা কোনদিন এ পৃথিবী থেকে চলে যাব।


আসুন,এই ফ্যান্টাসি থেকে সবাই বের হয়ে আসি।নিজের জীবনে,পরিবারে,সমাজে আসল জীবনের উদ্দেশ্য প্রতিষ্টা করি।নিজের যা আছে তা নিয়ে রবকে শূকরিয়া জানাই।আজ থেকে এভাবে বলি সিজদায়,"আল্লাহ,ইয়া রব,আপনি আমাকে যা দিয়েছেন এর জন্য আলহামদুলিল্লাহ।আপনার দরবারে লাক্ষ,কোটি শূকরিয়া,আমাকে আপনার দেয়া বিধান অনুযায়ী সঠিক ভাবে চলার তৈফিক দিন"।বেশি বেশি শূকরিয়া আদায় করুন।আল্লাহর দেয়া প্রতিটা নিয়ামতকে " আলহামদুলিল্লাহ"বলুন।

একটা দ্বীনি সমাজ তৈরি করি,যাতে সবার দ্বীন প্র্যাক্টিস করা সহজ হয়।আল্লাহ যেম এই ফ্যান্টাসি নামক কারাগার বেড়িয়ে আসার পথ  সহজ করে দেন।আমিন।

Comments

Popular posts from this blog

এক খন্ড হতাশা

বিষাক্ত মাকড়সার জাল

মৃত্যু যন্ত্রনা (Death Pain)